মুক্তিকন্ঠ

ভয়েস অফ ফ্রিডম ফাইটার ১৯৭১

টুর্নামেন্ট কমিটির টিম!

এ কে এম জামীর উদ্দীন, সাংবাদিক ও গবেষক

শেয়ার করুন

এ কে এম জামীর উদ্দীন, সাংবাদিক ও গবেষক, যুক্তরাষ্ট্র

কৈশোরের কিছু ঘটনা মনে পড়লে এখনও নিজে নিজে হাসি। ফুটবলকে হটিয়ে ক্রিকেট ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায় আমাদের কৈশোরে। সে সময় আমরা ক্রিকেট টুর্নামেন্টের আয়োজন করতাম পাড়ায় পাড়ায়। একটা নির্দিষ্ট শারীরিক উচ্চতার কিশোররা সেই টুর্নামেন্টে অংশ নিতে পারতো। অধিকাংশ ক্ষেত্রে পাঁচ ফিট পাঁচ ইঞ্চি উচ্চতার কিশোর‌‌দের সেইসব টুর্নামেন্টে অংশ নেওয়ার সুযোগ দেওয়া হতো। আশপাশের বিভিন্ন পাড়া বা ইউনিয়নের তরুণদের ক্রিকেট টিম সেখানে অংশ নিতো। টুর্নামেন্টে অংশ নিতে হলে ৭০-৮০ টাকা পর্যন্ত অংশগ্রহণ ফি জমা দিতে হতো প্রতি টিমকে। মজার বিষয় হচ্ছে, প্রত্যেকটা প্রতিযোগিতায় টুর্নামেন্ট কমিটির একটি টিম থাকতো। অর্থাৎ ওই টিমটি প্রকারন্তরে ছিল স্বাগতিক। এরপর শুরু হতো ছলচাতুরী। টুর্নামেন্ট কমিটির টিমকে জিতিয়ে আনার জন্য সব রকমের কৌশলই অবলম্বন করা হতো। কৈশোর থেকেই আমার শারীরিক গঠন লম্বা হওয়ায় সেসব টুর্নামেন্টে আমার মতো অনেকের অংশ নেওয়ার সুযোগ হতো না। খেলোয়াড়দের উচ্চতা মাপার কাজকর্মে পাড়ার সিনিয়ররা দায়িত্বে থাকতো। এটা এক ধরনের বিচারিক কাজও বটে। আমার এক চাচতো ভাই ছিল। এখনো সে আছে। একটু দুষ্ট প্রকৃতির। তার উচ্চতা আনুমানিক পাঁচ ফিট ছয় বা সাত ইঞ্চি ছিল ওই সময়। কিন্তু সে শরীরকে আাঁকা-বাঁকা করে এক অনন্য প্রক্রিয়ায় পাঁচ ফিট পাঁচ ইঞ্চিতে নিয়ে আসতো। আর টুর্নামেন্ট কমিটির বিচারকদের কাজ হচ্ছে সেই ভূল মেজরমেন্টকে স্বীকৃতি দেওয়ার চেষ্টা করা। এরপর ছিল নিজেদের আম্পায়ার নিয়োগ দেওয়া। সেই আম্পায়ারদের প্রাণপণ চেষ্টা ছিল কমিটির টিমকে চ্যাম্পিয়ন বানানো। এবং মজার বিষয় হচ্ছে কমিটির টিমই চ্যাম্পিয়ন হতো। এরপর সেই চ্যাম্পিয়ন ট্রফি নিয়ে হাটবাজারে গিয়ে টাকা তোলা হত। অর্থাৎ দিনশেষে দেখা যেতো, খরচের চেয়ে টাকার অঙ্কে লাভের পাল্লা বেশি হতো। তবে সবসময় ছক মতো হতো না। সব আয়োজন থাকা সত্ত্বেও মাঝেমধ্যে কমিটির টিম চ্যাম্পিয়ন হতে পারতো না। পরে বুঝতে পেরেছি, টুর্নামেন্ট কমিটির টিম দেওয়ার এই অনুশীলন আমাদের পাড়াগুলোকে ছাড়িয়ে ফিফা ফুটবল বিশ্বকাপেও মাঝে মধ্যে দেখা যায়।

আমাদের কৈশোরের সেই টুর্নামেন্ট কমিটির টিমের মতোই বাংলাদেশের রাজনীতি। ১৫ বছর আমরা দেখেছি, আওয়ামী লীগ টুর্নামেন্ট কমিটির রোল প্লে করার মাধ্যমে কীভাবে নির্বাচনে জিতে এসেছে। আর বিএনপি বেচারা বছরের পর বছর ধরে টুর্নামেন্ট কমিটির কাছ থেকে কি এক ভয়ঙ্কর নিগ্রহের স্বীকার হলো। বিএনপি এখন ঘর পোড়া গরু। অর্থাৎ ঘর পোড়া গরু সিঁদুরে মেঘ দেখলে ভয় পায়। সিঁদুরে মেঘ এখানে আলাদা জিনিস, যার অর্থ লাল মেঘ। এর মানে হলো, ওই গরুর ঘরে আগে আগুন লেগেছিল, তাই আকাশে লাল মেঘ দেখে তার মনে হয় আবার আগুন লেগেছে। সেই ঘর পোড়া গরুর মতো বিএনপির দাবি, এখন নতুন করে কিংস পার্টি হচ্ছে। অর্থাৎ টুর্নামেন্ট কমিটি টিম দিচ্ছে ইলেকশনে খেলার জন্য।

গোটা বাংলাদেশই জন্মের পর থেকে অগ্নিকাণ্ডে জর্জরির। ১৯৭১ সালের পর থেকে এখানে প্রত্যেকটা সরকার ক্ষমতার প্রশ্নে ফ্যাসিস্ট হয়েছে। শুধুমাত্র তিনমাস মেয়াদী তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া। ২০০৭ সালে এখানে ইউনুস টাইপের আরেকটি সরকার এসেছিল। আমরা দেখেছিলাম, সেই সরকার ছয়-সাত মাসের মধ্যে একটা ফ্যাসিস্টে রূপ নিয়েছিল। ইমারেজেন্সি ব্রেক মামলা দিয়ে আমাদের অনেককে বাড়ি-ঘর ছাড়া করে দিয়েছিল। তবে ওই সরকার প্রথমদিকে কমিটির টিম দিতে চাইলেও শেষ পর্যন্ত সফল হয়নি।

আগামী কয়দিন পর এখানে একটা নতুন রাজনৈতিক দলের আত্মপ্রকাশ ঘটতে যাচ্ছে। এটা নিয়ে ব্যাপক কথা-বার্তা এখন মাঠে-ঘাটে। ইতিমধ্যে একজন সরকারি উপদেষ্টা পদত্যাগ করে সেই দলে যোগ দিতে যাচ্ছেন। রাজনীতি করা মানুষের মৌলিক অধিকার। কিন্তু আমরা যে মূল্যবোধ দেখতে দেখতে বড়ো হয়েছি, সেটা সংশয় জাগায়। কেননা, আমরা পাড়া-মহল্লাতেই যেকোনো উপায়ে টুর্নামেন্ট কমিটির টিমকে জিতিয়ে নিয়ে আসার চেষ্টা করতাম। আর এটাতো খোদ রাষ্ট্র ক্ষমতা। গণঅভ্যুত্থানের মৌলিকত্ব হচ্ছে, এই ধরেনর ক্রিয়া মানুষের নৈতিকতাকে পরিশুদ্ধ করে। কারণ লড়াই মানুষকে সুন্দর করে। আজকে যা কিছু সুন্দর, সব কিছু লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে অর্জিত হয়েছে। লড়াই মানুষের আদিম প্রবৃত্তিকে পরিবর্তন করেছে। এবারের বাংলাদেশের গণঅভ্যুত্থানে সেরকমটা হয়েছে কি-না তা নিয়ে পাঠ অথবা প্রতিপাঠ — দুটো করারই সময় চলে এসেছে এখন। যদি কোনোভাবেই পুরনো ধরনকে সামনে রেখে কোনো একটা টুর্নামেন্ট কমিটির টিম এখানে চলে আসে, তাহলে পুরনো আওয়ামী লীগ এখানে পুরনো ঢঙে ফিরে আসবে। অর্থাৎ নষ্ট ও নোংরা বোধগুলো এখানে ফিরে আসবে। রাজনৈতিক দল হোক, কিন্তু সেটা যেন টুর্নামেন্ট কমিটির টিম না হয়। কারণ, ওই ধরনের টিম নিয়ে বহু বছর পরেও হাসি-তামাশা হবে। আর এই ধরনের অ্যাকটিভিটি চূড়ান্তভাবে বিরাজনীতিকীকরণকেই ব্যাপকমাত্রায় শক্তিশালী করবে।

 


শেয়ার করুন